অনলাইন ডেস্ক::
একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারে কণ্ঠে কণ্ঠে সেই গান- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি… আমি কি ভুলিতে পারি…।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। রক্তের দামে এসেছিল বাংলার স্বীকৃতি আর তার সিঁড়ি বেয়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির এই আত্মত্যাগের দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বে।
গর্ব আর শোকের এই দিনটি বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করেছে জাতি, যার সূচনা হয়েছে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে।
এবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এসেছে মহামারীর বাস্তবতায় ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের আয়োজনটি এবার হচ্ছে সীমিত পরিসরে।
প্রতি বছর একুশের প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার প্রধানের তরফ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাঙালির শ্রদ্ধা জানানোর পর্ব। মহামারীর মধ্যে এ বছর তাদের পক্ষে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন তাদের সামরিক সচিবরা।
রাষ্ট্রপতির পক্ষে ফুল দেন তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম। আর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় দলের জ্যেষ্ঠ নেতা মতিয়া চৌধুরী, ফারুক খান, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ তার সঙ্গে ছিলেন।
পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংসদের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস কমডোর এমএম নাঈম রহমান।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শাহীন ইকবাল এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এরপর।
পরে মন্ত্রিসভার সদস্য, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
বিশিষ্টজনদের শ্রদ্ধা জানানোর পর উন্মুক্ত সবার জন্য উন্মুত্ত হয় শহীদ মিনার। সেজন্য আগেই অনেকে ফুল হাতে বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন।
শ্রদ্ধানুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে পালনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সাধারণের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করা করা হয়; পথ চলায়ও রয়েছে নিয়ন্ত্রণ।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে শুক্রবার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে একটি দেয়ালে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ফুটিয়ে তুলছেন শিল্পী । ছবি: মাহমুদ জামান অভি
একুশের চেতনা ছড়িয়ে যাকআন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, “যে বাংলা ভাষার জন্য আমরা জীবন দিয়েছি, তার উন্নয়নে সর্বস্তরে শুদ্ধ বাংলার প্রচলনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। নিজভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণের পাশাপাশি বহুভাষিক শিক্ষার মাধ্যমে টেকসই ভবিষ্যৎ-বিনির্মাণ করতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন ইতিবাচক অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।”
একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবদুল হামিদ বলেন, “ভাষা-আন্দোলন ছিল আমাদের মাতৃভাষার অধিকার-প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি নিজস্ব জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষারও আন্দোলন। আমাদের স্বাধিকার, মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে অমর একুশের অবিনাশী চেতনাই যুগিয়েছে অফুরন্ত প্রেরণা ও অসীম সাহস।
“ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা পথ বেয়েই অর্জিত হয় মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি এবং এরই ধারাবাহিকতায় আসে বাঙালির চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাতৃভাষার জন্য জীবন-উৎসর্গ বিশ্বে বিরল ঘটনা।”
পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিপন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, “পৃথিবীতে অনেক ভাষাই এখন বিপন্ন। একটা ভাষার বিলুপ্তি মানে একটা সংস্কৃতির বিলোপ, জাতিসত্তার বিলোপ, সভ্যতার অপমৃত্যু। তাই মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশসহ সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতিরক্ষায় বিশ্ববাসীকে সোচ্চার হতে হবে।”
একুশের চেতনা ধারণ করে পৃথিবীর নানা ভাষাভাষী মানুষের সাথে নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হোক, লুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো আপন মহিমায় নিজ-নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে উজ্জীবিত হোক, গড়ে উঠুক নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য বিশ্ব- শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সেই প্রত্যাশা রেখেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেছেন, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা-আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা/রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়।
“১৯৫২ সালের এ দিনে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা করতে প্রাণ-উৎসর্গ করেছিলেন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমানসহ আরও অনেকে। এ দিনে আমি বাংলাসহ বিশ্বের ভাষা-শহিদগণের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
“পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি বাংলাভাষার মর্যাদাপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃত্বদানকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল ভাষাসৈনিকদের, যাদের দূরদর্শী ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে এবং সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের মা, মাটি ও মানুষের অস্তিত্ব রক্ষা হয়েছে।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ বাঙালির গৌরবময় ঐতিহাসিক দলিলে ভাষা-আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলো কালে-কালে আমাদের জাতীয় জীবনে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। এতদঞ্চলের শান্তিপ্রিয় জনসাধারণের স্বার্থসুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিটি অর্জনের পেছনে রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস।”
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা তুলে ধরে তার মেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা সকল দাপ্তরিক কাজে বাংলাভাষা ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন। বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিয়ে আমাদের মাতৃভাষাকে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন।
“একটি বিশেষ মহল বাংলাভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় এবং বাঙালি সত্তার বিকাশে জাতির পিতার অবদানকে মুছে ফেলতে সবসময়ই তৎপর। জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দা শাখার গোপন দলিল প্রকাশের মধ্য দিয়ে সে সকল অপতৎপরতা রুখে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। “
সরকারপ্রধান জানান, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর লুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণ ও মর্যাদা রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করেছে সরকার। বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীর জন্য প্রাথমিক স্তরে পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তন করা হয়েছে। এখন সরকার চেষ্টা করছে জাতিসংঘ যেন দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়।
একুশের আয়োজন
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির আয়োজন হয় মূলত শহীদ মিনার কেন্দ্রিক, এর বাইরেও নানা অনুষ্ঠান থাকে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে এবার সব আয়োজনেই স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়ি থাকছে।
প্রতিটি সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৫ জন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ২ জন শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে পারবেন। মাস্ক ছাড়া কাউকে শহীদ মিনার চত্বরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবারের মাতৃভাষা দিবসের প্রতিপাদ্য ঠিক করেছে ‘শিক্ষায় এবং সমাজে বহুভাষার অন্তর্ভুক্তি সযত্নে লালন করি’।
রোববার বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, আরকাইভস্ ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউণ্ডেশন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক একাডেমি, বিরিশিরি, নেত্রকোণা, রাজশাহী বিভাগীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি, মণিপুরী ললিতকলা একাডেমি, কক্সবাজার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গ্রন্থমেলা, আলোচনা সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, সুন্দর হাতের লেখা ও রচনা প্রতিযোগিতাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।
তাছাড়া জাতীয় জাদুঘর ও শাখা জাদুঘরগুলো এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সব প্রত্নস্থল ও জাদুঘরে শিশু-কিশোর, শিক্ষার্থী, বৃদ্ধ ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের বিনা টিকেটে পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
আজিমপুর কবরস্থানে ফাতেহা পাঠ ও কোরআনখানিসহ দেশের সকল উপাসনালয়ে এদিন ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাতের জন্য প্রার্থনা করা হবে।