দেশের প্রাপ্তবয়স্কদের চারজনের একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। আর ১০ জনের ১ জন আক্রান্ত ডায়াবেটিসে। দুটি রোগই বাড়ছে। রোগ দুটি শহরাঞ্চলে এবং উচ্চ আয়ের মানুষের মধ্যে বেশি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান। কিন্তু উচ্চ রক্তচাপ নারীদের মধ্যে বেশি।
ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ের এ তথ্য উঠে এসেছে ‘বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭–১৮’ প্রতিবেদনে। গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এই তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)।
মূলত পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর কারণ, বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি এবং উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস—তিনটি বিষয়ে জরিপের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে বলা হয়, চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরির কাজ চলছে। নিপোর্ট মাস দুয়েক আগেই তাদের ওয়েবসাইটে প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করেছিল। তবে সেখানে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের কোনো তথ্য ছিল না।
প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, অপুষ্টির শিকার নারী–পুরুষের মধ্যে ডায়াবেটিস দ্রুত বাড়ছে। আবার বেশি বয়স্কদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বেশি। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং এদের সারা জীবন চিকিৎসা দরকার।
নিপোর্টের সঙ্গে জরিপে যুক্ত ছিল আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি), যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয় ও আইসিএফ ইন্টারন্যাশনাল নামের মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান। জরিপে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি। জরিপ হয়েছিল ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত।
আইসিডিডিআরবির অসংক্রামক রোগ কর্মসূচির প্রধান আলিয়া নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, এই জরিপে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগ বিষয়ে ভিত্তিমূলক তথ্য পাওয়া গেছে। কারণ, এই প্রথম প্রাপ্তবয়স্কদের তথ্য জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকার এসব রোগ প্রতিরোধে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এসব কর্মসূচি কতটুকু সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা জানা যাবে পরবর্তী জরিপের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে।
ডায়াবেটিস পরিস্থিতি
জরিপ বলছে, বর্তমানে দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষ ১ কোটি ১০ লাখ। ১৮–৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে এই সংখ্যা ২৬ লাখ। আর ৩৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সীদের মধ্যে ৮৪ লাখ। ডায়াবেটিস পরিস্থিতি জানার জন্য ৬ হাজার ৯৯৭ জন নারী ও ৫ হাজার ২৯৯ জন পুরুষের রক্তে শর্করা পরীক্ষা করা হয়েছিল।
জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৬০ শতাংশ নারী ও পুরুষ জানেই না যে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। মাত্র ১৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী তাঁদের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানেন। তাঁরা নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আছে।ডায়াবেটিস সম্পর্কে জানেন এবং চিকিৎসাও নিচ্ছেন, অথচ ২২ শতাংশের বেশি নারী–পুরুষের তা নিয়ন্ত্রণে নেই।
তবে পরিস্থিতির যে অবনতি হচ্ছে, সে তথ্যও জরিপে উঠে এসেছে। ২০১১ সালে ৩৫ বছর বা তার বেশি বয়সী নারীদের ১১ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। এখন সেই হার ১৪ শতাংশ। পুরুষের মধ্যেও একইভাবে ডায়াবেটিস বেড়েছে।
জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০১৭-১৮। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ বাড়ছে। মানুষের সচেতনতা যেমন কম, প্রতিরোধের উদ্যোগও সীমিত।
দেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ অসংক্রামক ব্যাধি। মোট মৃত্যুর ৬০ শতাংশের বেশি হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, কিডনি রোগ, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের মতো অসংক্রামক রোগে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহাজাদা সেলিম ডায়াবেটিস নিয়ে গবেষণা করছেন। নিপোর্টের জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য সম্পর্কে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছোট–বড় নানা গবেষণার তথ্য থেকে ধারণা করা যায়, নিপোর্ট যা বলছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার তার চেয়েও বেশি। টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত একটি মহিলা কলেজে ছাত্রীদের এবং ঢাকার একটি মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের রক্ত পরীক্ষায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের ২০ শতাংশের বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।’
উচ্চ রক্তচাপের চাপ
উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন দেশে এমন নারী পুরুষ ২ কোটি ৯৯ লাখ। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সের ২৮ শতাংশ নারী ও ২৬ শতাংশ পুরুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। বর্তমান পরিস্থিতি চলতে থাকলে ১০ বছর পর উচ্চ রক্তচাপে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৩ কোটি ৭৮ লাখে।
এত বিপুল পরিমাণ মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগলেও এ ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কম, এমন তথ্য জরিপে উঠে এসেছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত প্রায় অর্ধেক নারী ও দুই–তৃতীয়াংশ পুরুষ জানেনই না যে তাঁরা এ সমস্যায় ভুগছেন। সমস্যা সম্পর্কে জানেন, চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আছে এমন নারী ও পুরুষের হার যথাক্রমে ১৫ ও ৯ শতাংশ।
২০১১ সালের জরিপের সঙ্গে তুলনা করে দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ আগের চেয়ে খারাপ হচ্ছে। ২০১১ সালে ৩৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ৩২ শতাংশ নারী ও ১৯ শতাংশ পুরুষ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ছিলেন। ২০১৭ সালে সেই হার বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৫ ও ৩৪ শতাংশ।
জরিপকারীরা ৭ হাজার ৪২৯ জন নারী ও ৫ হাজার ৭০০ পুরুষের রক্তচাপ পরীক্ষা করেছিলেন।
উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ গ্রামের চেয়ে শহরের নারী ও পুরুষের মধ্যে বেশি। একইভাবে সবচেয়ে ধনিক শ্রেণির নারী–পুরুষের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের প্রকোপ বেশি। দরিদ্রতম শ্রেণির মধ্যে এর প্রকোপ সবচেয়ে কম।
সরকার কী করছে
জরিপ প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত গবেষকেরা গতকাল ফলাফল উপস্থাপনের সময় উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় সরকার কী করছে, তারও কিছুটা বর্ণনা দেন। দেশে বর্তমানে ৩০টি উপজেলায় জাতীয় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। ২০২২ সালের মধ্যে ২০০টি উপজেলায় তার বিস্তার ঘটানো হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সহকারীরা ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করে।
অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সদ্য বিদায়ী পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য শিক্ষা) এ এম এইচ এনায়েত হোসেন বলেন, লবণ–চিনি কম খাওয়া, ধূমপান না করা, শরীরচর্চার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে এসে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানোর জন্য উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে দুটো রোগেরই বিনা মূল্যে ওষুধ দেওয়া হচ্ছে।
তবে প্রয়োজন বা সমস্যার ব্যাপকতার তুলনায় উদ্যোগ অপ্রতুল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মহামারি আকারে ধেয়ে আসা এ সমস্যার সুসংগঠিত সমাধান দরকার। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জাতীয় নীতিমালার একটি খসড়া সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষে কোনো সাড়া নেই।