এডিস মশা থেকে বাঁচতে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দাওয়াইয়ের খোঁজ করছে দেশবাসী। মশা তাড়াতে ধূপ ব্যবহারে ঝুঁকছে অনেকে। কেউ কেউ ব্যস্ত নিমপাতা সংগ্রহে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমনও বলা হচ্ছে, নারকেল তেল ব্যবহারে এড়ানো যাবে মশার কামড় আর পেঁপেপাতার রসে সারবে ডেঙ্গু। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মশা তাড়াতে নিমপাতাই যথেষ্ট আর ধূপের কিছুটা কার্যকারিতা আছে। কিন্তু নারকেল তেলে মশা তাড়ানোর মতো কোনো উপাদান নেই। এ ছাড়া পেঁপেপাতার রসে ডেঙ্গু সারবে—এমন তথ্যেরও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। সম্প্রতি কীটতত্ত্ববিদ, কৃষিবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ভারতের জাতীয় ম্যালেরিয়া গবেষণা ইনস্টিটিউট (এনআইএমআর) কেরোসিনের সঙ্গে নিমের তেল দিয়ে একটি সংমিশ্রণ তৈরি করেছিল।
কেরোসিনের সঙ্গে এক ভাগ নিম তেল মিশিয়ে তা একটি কক্ষে পোড়ানো হয়। ম্যালেরিয়া ও কিউলেক্স প্রজাতির মশা নিয়ন্ত্রণে এই প্রক্রিয়াটি দারুণ উপযোগী বলে ১৯৯৪ সালে জানায় সংস্থাটি। তবে এডিস মশা তাড়াতে এই পদ্ধতি কতটা কার্যকর সে ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।
এদিকে মশাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ তাড়াতে বহু আগে থেকেই ভারত উপমহাদেশে ব্যবহৃত হয়ে আসছে ধূপ। মশা মারতে সক্ষম না হলেও ধূপের ধোঁয়া মশা তাড়াতে সক্ষম বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা। তবে ধূপের ধোঁয়া মানবস্বাস্থ্যের জন্য উপকারী নয় বলে জানান তাঁরা।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিমে কীটপতঙ্গ তাড়ানোর মতো উপাদান রয়েছে। আর ধূপের ধোঁয়া মশাসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গ তাড়াতে পারে। নিমের তেল বা রস ব্যবহারের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। তবে ধূপের ধোঁয়া মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।’
কৃষিবিদ এ আর চন্দন জানান, নিমের ভেষজ গুণ অতুলনীয়। নিমের পাতা থেকে বাকল, শিকড় থেকে ফুল, ফল থেকে বীজ—সবই কাজে লাগে। অনাদিকাল ধরে চলে আসছে নিমের বহুমুখী ব্যবহার। নিম পরিবেশ রক্ষা করে। দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক অবদান রাখে। নিম থেকে উত্পাদিত হয় প্রাকৃতিক প্রসাধনী, ওষুধ, জৈব সার ও কীটপতঙ্গবিতাড়ক উপাদান। নিমকাঠ ঘুণে ধরে না, নিমের আসবাব ব্যবহারে ত্বক ভালো থাকে। নিম পানিস্তর ধরে রাখে, শীতল ছায়া দেয় এবং ভাইরাস প্রতিরোধ করে। শিল্প বিপ্লবের ফলে উদ্ভূত দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে নিম। এটি মাটির লবণাক্ততা রোধ করে এবং অম্ল ও ক্ষারের সমতা ফেরায়। নিমগাছ বাতাস শীতল রাখে এবং অন্যান্য গাছের তুলনায় নিমগাছের নিচে তাপমাত্রা ১-২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে। নিমপাতার গুঁড়া ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে উপকারী। শুকনো নিমপাতা ধান-চালের গোলায় বা ডাল ও গমের পাত্রে রাখলে ওই সব খাদ্যশস্য পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়। নিমপাতা বেটে ১ঃ১০ অনুপাতে পানিতে মিশিয়ে পোকা আক্রান্ত ক্ষেতে প্রয়োগ করলে উপকার পাওয়া যায়। বীজ সংরক্ষণে নিমপাতা অব্যর্থ মহৌষধ। প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের জন্য এত উপকারী গাছ এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। নিমের বহুমুখী গুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) একে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে যে নারকেল তেল ব্যবহার করলে মশা কামড় দেবে না। ইন্দোনেশিয়া, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই গুজব বড় পরিসরে রটানো হয়েছে চলতি বছর। ইন্দোনেশিয়ার একটি হাসপাতালের ডাক্তার বি সুকুমারের নামে এই গুজব রটানো হয়। এই গুজবে বিরক্ত ড. সুকুমার এ ধরনের কোনো মন্তব্য করেননি বলে জানিয়েছেন বার্তা সংস্থা এএফপিকে। ইন্দোনেশিয়ার জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. অ্যাডভেল সালভানার এএফপিকে বলেন, ‘নারকেল তেলের ব্যবহার মশার কামড় থেকে রক্ষা করবে—এই তথ্য অবৈজ্ঞানিক। এ ছাড়া এ ধরনের কোনো গবেষণা প্রবন্ধ সম্পর্কেও আমি জানি না।’
একই সঙ্গে পেঁপেপাতার রস খেলে ডেঙ্গু উপশম হবে বা উপশমে সহায়তা করবে—এ ধরনের তথ্যেরও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তবে তাঁরা বলছেন, পেঁপেপাতার রস খেলে স্বাস্থ্যের কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু কোনো ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী যদি পেঁপেপাতার রস খেয়ে আরোগ্য হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে যায়, তবে তা ভয়াবহ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নিম ও ধূপ কীটপতঙ্গ তাড়াতে ব্যবহৃত হতো অনেক আগে থেকে। তবে এডিস মশার ক্ষেত্রে কতটা উপকারী হবে তা নিশ্চিত নই আমরা। তবে এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নারকেল তেলে মশা তাড়ানোর মতো কোনো উপাদান নেই। এ ছাড়া পেঁপেপাতার রসে ডেঙ্গু সারবে—এটারও বৈজ্ঞানিক কোনো ভিত্তি নেই। পেঁপেপাতার রস শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে ডেঙ্গু হলে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে শুধু পেঁপেপাতার রস খেলে রোগীর অবস্থা আরো ভয়াবহ হতে পারে।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মুজিবুর রহমানও সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে বলেন, পেঁপেপাতার রস যে ডেঙ্গু নিরসনে ভূমিকা রাখে, এ দাবির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
মশা তাড়াতে নারকেল তেল ব্যবহার প্রসঙ্গে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক তাহমিনা আখতার বিবিসি বাংলাকে বলেন, তিনি এ পদ্ধতির বিষয়ে পুরোপুরি একমত নন। তিনি মনে করেন, মশা যেহেতু চামড়া ভেদ করে রক্ত পান করে, তাই চামড়ার ওপর ঘন যেকোনো ধরনের তেলই মশাকে কিছুটা প্রতিহত করতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে নারকেল তেলের সঙ্গে ন্যাফথালিন বা কর্পূরের গুঁড়া মেশালে তা আরো বেশি কার্যকর হতে পারে। আর কড়া গন্ধ থাকায় নারকেল তেলের বদলে সরিষার তেল বেশি কার্যকর হতে পারে।