জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ যখনই কানে বাজে, তখনই স্নায়ুতন্ত্রের ওপর এক অজানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কে গিয়ে এই আওয়াজ প্রবল প্রভাব বিস্তার করে। তখন মস্তিষ্কে অন্য চিন্তা আর জায়গা নিতে পারে না।
এক মোহনীয় আকর্ষণ মনকে অন্য দিগন্তে নিয়ে যায়। এমনকি চলন্ত যানবাহনে চলাচলকারী বা অন্য কাজে নিমগ্ন মানুষের মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সর্বদা অভাবনীয় এক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। বাঙালির মুক্তির দূত হয়ে এক নবজাগরণ সৃষ্টি করে। তাই একে এ দেশের মানুষের মুক্তিনামা হিসেবে আখ্যা দেয়া যায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের রয়েছে জাদুকরী আকর্ষণ। বিশেষ করে ৭ মার্চের ভাষণ।
ভাষণের কথাগুলো চিন্তা করলে তা কোনো সূত্রের মধ্যেই ফেলা যায় না। সবকিছু ছাপিয়ে তা এক অনন্য উচ্চতায় উঠে যায়। বহু গবেষণা হয়েছে। আরও হবে। তারপরও এর রহস্য উন্মোচিত হবে কিনা, আমরা সন্দিহান।
যোগাযোগ বিজ্ঞানীদের মতে, কোনো ভাষণে গড়ে ৫৮ থেকে ৬০টি শব্দ উচ্চারণ করতে পারলে সেটা হয় আদর্শ ভাষণ। এটি সম্ভব হয় ঊীঃবসঢ়ড়ৎব ভাষণে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে সেটা তারা খুঁজে পেয়েছেন। কেউ কেউ বলেন, একটা ভাষণের শুরুতে যেভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করার প্রয়োজন সেটাও ছিল এ ভাষণে। অনেকে বলেন, শ্রোতার যেন ধৈর্যচ্যুতি না হয় সেজন্য ভাষণে কোনো শব্দ বেশি পুনরাবৃত্তি করা ঠিক নয়। আবার ভাষণের দৈর্ঘ্যও যেন খুব বেশি না হয়। বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের ভাষণে তারা এসব উপাদান খুঁজে পেয়েছেন। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণে গভীর দৃঢ়তা ও ছন্দ খুঁজে পেয়েছেন। এগুলো হয়তো ভাষার অলঙ্কার হয়ে কাজ করেছে।
তবে আমি ভাবি অন্যভাবে! অনেকেই অনেক সুন্দর বক্তৃতা করেন; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো জনপ্রিয় বা শব্দের কার্যকর প্রভাবক হতে পারেন না। তাহলে দেখা যায় সুন্দর ভাষণেই বঙ্গবন্ধু হওয়া যায় না। আবার অনেকে বঙ্গবন্ধুর দৈহিক সৌন্দর্য ও পোশাকের এক অনন্য মিলনে মুগ্ধ। অনেক গুণীজন বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করলেও জনপ্রিয়তায় বা মোহনীয়তায় তার ধারেকাছে যেতে পারেন না।
আবার অনেকে বঙ্গবন্ধুর পোশাকে তাকে অনুসরণ করতে গিয়ে নিজেকে তামাশার পাত্র বানিয়ে ফেলেন। কেন তারা বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে অনুকরণ করতে পারেন না? এসব চিন্তা আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে, যা আমি ফিদেল কাস্ত্রোর একটি উক্তিতে অনেকটাই খুঁজে পাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সে সময় তিনি বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়াস। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব।
ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইস দ্য হিমালয়াস। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দি এক্সপেরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়াস।’ ফিদেল কাস্ত্রোর হিমালয়ের সঙ্গে তুলনাটাই প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর পরিচয় বহন করে। আর প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু হিমালয়ের মতোই বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তার এই বিশালতাকে অনেকে দ্রুত আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে, যা কোনোদিনও সম্ভব নয়। সাফল্যের যেমন সংক্ষিপ্ত কোনো রাস্তা নেই, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে স্বল্পপরিসরে আয়ত্ত করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ আবার তার সৌন্দর্য অনুসরণ করছে। ফলে প্রকৃত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আমরা পাচ্ছি না।
কেউ কখনও হিমালয়ের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে না। করলেই দেখতে পেত বঙ্গবন্ধু যা বলতেন সেটাই তিনি মনের গভীরে চিন্তা করতেন এবং ঠিক সেই কাজটিই তিনি করতেন। অর্থাৎ তার চিন্তা, কথা আর কাজের মধ্যে বিন্দুমাত্র ব্যবধান ছিল না।
জনগণকে আমরা যত বোকাই মনে করি, তারা ঠিক তার উল্টো। তারা সবকিছু বুঝতে পারে। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একটা আদি অনুভব আছে। সেটা হল দিনশেষে সে নিজের লাভের কথা চিন্তা করে। এবং সে হিসাব মনের অজান্তে করে। এখানেই রয়েছে মূল রহস্যটা। মানুষ তার অবচেতন মনের হিসাব খাতায় মিলিয়ে দেখে। নেতা কী বললেন আর আমি কী পেলাম! আর এখানেই বঙ্গবন্ধুকে নতুনভাবে খুঁজে পায় তারা।
যখন সে দেখে প্রথম জীবনেই বঙ্গবন্ধু জেলে গিয়েছিলেন নিজের জন্য নয়, বন্ধুর কারণে। যখন সে দেখে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্ব বর্জন করেছেন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর স্বার্থ রক্ষার্থে। যখন সে দেখে সাংবাদিকের এক প্রশ্নের (তুমি জেলে থাকার সময়গুলোতে কী ভাব?) উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমার দেশের জনগণের কথা।’ তারপর কী ভাব? ‘তাদের মুক্তির কথা।’ তারপর কী ভাব? ‘আমার পরিবারের কথা।’ এখানেই জনগণের কাছে বঙ্গবন্ধু হিমালয় হয়ে ওঠেন। তার কাজকে অনুকরণ করতে হবে সারাজীবন ধরে। ৭ মার্চের ভাষণ দেয়ার আগে অনেকে অনেকভাবে তাকে পরামর্শ দিয়েছেন।
কেউ কেউ লিখিত ভাষণ দেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের পরামর্শই গ্রহণ করেছিলেন। বেগম মুজিব বলেছিলেন, তোমার অন্তরে যেটা আসে সেটাই বলবে। কারণ তিনি জানতেন বঙ্গবন্ধুর অন্তরে থাকে গভীর সত্য। সেটাই জনগণের জন্য শ্রেষ্ঠ উপহার।
সবশেষে বলতে চাই, আমরা বঙ্গবন্ধুকে শুধু বাহ্যিক পোশাক, দৈহিক সৌন্দর্য, বক্তৃতার স্টাইলে খুঁজলে কখনই সম্পূর্ণ বঙ্গবন্ধুকে পাব না। বঙ্গবন্ধুর কর্মজীবনকে খুঁজলে তার চেয়ে অনেক বেশি পাব। তাতেই তার স্বপ্ন আর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ আমাদের মুক্তিনামা হয়ে কাজ করবে।
অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী : উপাচার্য, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়